২০৪১ সালে গ্যাসের ৬৮% আসবে এলএনজি থেকে

Passenger Voice    |    ০৫:০১ পিএম, ২০২৪-০২-২০


২০৪১ সালে গ্যাসের ৬৮% আসবে এলএনজি থেকে

আন্তর্জাতিক বাজারে দামের অস্বাভাবিক ওঠানামা ও দেশে ডলার সংকটের কারণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে হোঁচট খায় সরকার। এতে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে এলএনজি নিয়ে বিলাসিতা এখনও কাটেনি। ২০৪০-৪১ অর্থবছর দেশে সরবরাহকৃত গ্যাসের প্রায় ৬৮ শতাংশ এলএনজি থেকেই আসবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর পেট্রোবাংলায় দেশের গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি এবং দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ বিষয়ক এক সেমিনারে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে আগামী ১৮ বছরে গ্যাসের সম্ভাব্য চাহিদা ও সরবরাহের চিত্র তুলে ধরা হয়। তবে দেশীয় স্থলভাগে (অনশোর) গ্যাস ক্রমেই কমে আসা এবং সমুদ্রসীমা (অনশোর) থেকে ন্যূনতম গ্যাস সরবরাহ করা হবে বলে পরিকল্পনায় দেখানো হয়।

প্রতিবেদনে ২০৪০-৪১ অর্থবছর পর্যন্ত গ্যাসের সম্ভাব্য চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি দেখানো হয়েছে। এতে চাহিদার সম্ভাব্য তিনটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চিত্রটি পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা প্রাক্কলন করেছেন। এতে দেখানো হয়েছে, চলতি অর্থবছর দৈনিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে চার হাজার ৭৩৪ এমএমসিএফ। আগামী অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে চার হাজার ৯৫৬ এমএমসিএফ, ২০২৯-৩০ অর্থবছর ছয় হাজার ৬৫৫ এমএমসিএফ, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর সাত হাজার ৩৯৯ এমএমসিএফ ও ২০৪০-৪১ অর্থবছর সাত হাজার ৭৫৮ এমএমসিএফ।

দ্বিতীয় চিত্রতে বিভিন্ন গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সম্ভাব্য বছরভিত্তিক চাহিদার ভিত্তিতে সার্বিক চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর দৈনিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে তিন হাজার ৮৮৩ এমএমসিএফ। আগামী অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার ৯৬৫ এমএমসিএফ, ২০২৯-৩০ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৯২ এমএমসিএফ, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর ছয় হাজার ৭২ এমএমসিএফ এবং ২০৪০-৪১ অর্থবছর ছয় হাজার ৯৮৬ এমএমসিএফ। যদিও তিনটি চিত্রের মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মনে করা হচ্ছে।

তৃতীয় চিত্রে শুধু বিদ্যুৎ খাতে বছরভিত্তিক বাড়তি চাহিদা বিবেচনা করা হয়েছে। তবে অন্যান্য খাতে গ্যাসের চাহিদা অপরিবর্তিত ধরে মোট চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর দৈনিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে দুই হাজার ৭৮৮ এমএমসিএফ। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কমায় সার্বিক চাহিদা দাঁড়াবে দুই হাজার ৪৯৮ এমএমসিএফ। তবে ২০২৯-৩০ অর্থবছর গ্যাসের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার ৯১ এমএমসিএফ, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর তিন হাজার ৭৮৫ এমএমসিএফ এবং ২০৪০-৪১ অর্থবছর চার হাজার ৮৯০ এমএমসিএফ। যদিও সম্ভাব্য গ্যাসের চাহিদার এ চিত্রটি খুব বেশি সংকোচনমূলক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গ্যাসের সম্ভাব্য সরবরাহ চিত্রে দেখানো হয়, বর্তমানে দৈনিক গড়ে তিন হাজার ২৯ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনশোর থেকে আসছে দুই হাজার ১৭৯ এমএমসিএফ এবং রিগ্যাসিফাইড এলএনজি বা আরএলএনজি থেকে ৮৫০ এমএমসিএফ। এ হিসাবে চলতি অর্থবছর এলএনজি থেকে মোট গ্যাস সরবরাহের ২৮ শতাংশ আসবে।

আগামী অর্থবছর দৈনিক গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার ৪০৭ এমএমসিএফ। এর মধ্যে অনশোর থেকে আসবে দুই হাজার ৪২৭ এমএমসিএফ ও আরএলএনজি থেকে ৯৮০ এমএমসিএফ। এ হিসাবে আগামী অর্থবছর এলএনজি থেকে মোট গ্যাস সরবরাহের ২৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ আসবে। গ্যাস সরবরাহ বাড়লেও চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থেকেই যাবে বলে দেখিয়েছে পেট্রোবাংলা।

২০২৯-৩০ অর্থবছর অনশোরের গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়াবে দৈনিক গড়ে দুই হাজার ১২২ এমএমসিএফ। সে বছর অফশোর থেকে দৈনিক গড়ে ১০০ এমএমসিএফ ও আরএলএনজি থেকে দুই হাজার ১৩০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে। এতে দৈনিক গড়ে গ্যাস সরবরাহ বেড়ে দাঁড়াবে চার হাজার ৩৫২ এমএমসিএফ। এর মধ্যে এলএনজির অংশ থাকবে প্রায় ৪৯ শতাংশ।

এদিকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর অনশোরের গ্যাস সরবরাহ অনেক কমে যাবে। সে অর্থবছর এ খাতের গ্যাস সরবরাহ দাঁড়াবে দৈনিক গড়ে এক হাজার ২৩৮ এমএমসিএফ। ওই সময় অফশোর থেকে দৈনিক গড়ে ৮৮০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে। আর আরএলএনজি থেকে তিন হাজার ৫৫৫ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে। এতে দৈনিক গড়ে গ্যাস সরবরাহ বেড়ে দাঁড়াবে পাঁচ হাজার ৬৭৩ এমএমসিএফ। এর মধ্যে এনএলজির অংশ থাকবে ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

একইভাবে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর অনশোরের গ্যাস সরবরাহ আরও কমবে। সে অর্থবছর এ খাতের গ্যাস সরবরাহ দাঁড়াবে দৈনিক গড়ে মাত্র ৮৭৪ এমএমসিএফ। ওই বছর অফশোর থেকে দৈনিক গড়ে ৮২০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে। আর আরএলএনজি থেকে তিন হাজার ৫৫৫ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে। এতে দৈনিক গড়ে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়াবে পাঁচ হাজার ২৪৯ এমএমসিএফ। এর মধ্যে এলএনজির অংশ ৬৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

যদিও ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেয়া উচিত। কারণ একদিকে ডলারের অনিশ্চয়তা আছেই। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামের নিশ্চয়তাও নেই। ফলে এ ধরনের বিলাসী পরিকল্পনা ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হতে পারে।

সেমিনারে জানানো হয়, মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রে স্থাপিত সামিটের এলএনজি সরবরাহের ভাসমান টার্মিনাল তথা ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) থেকে দৈনিক গড়ে ৫০০ এমএমসিএফ আরএলএনজি সরবরাহ সম্ভব। এটি আরও ১০০ এমএমসিএফ বৃদ্ধি করা যাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এলএনজির এফএসআরইউ থেকে দৈনিক গড়ে ৫০০ এমএমসিএফ আরএলএনজি পাওয়া সম্ভব। এটিকেও এক হাজার এমএমসিএফে উন্নীত করার কাজ চলছে। ১৫ বছর এগুলো থেকে এলএনজি সরবরাহ করা হবে। এছাড়া মাতারবাড়ীতে স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল করা হচ্ছে, যা থেকে দৈনিক গড়ে এক হাজার এমএমসিএফ আরএলএনজি পাওয়া যাবে। এটিও নির্মাণ করছে সামিট গ্রুপ।

সূত্রমতে, দুই ভাসমান টার্মিনালের জন্য দৈনিক গড়ে সাড়ে চার লাখ ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। এর মধ্যে এক্সিলারেট এনার্জি পায় দুই লাখ ৩৭ হাজার ডলার ও সামিট পায় দুই লাখ ১৭ হাজার ডলার। এতে বছরে চার ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ডলার বা এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। টার্মিনাল দুটি পূর্ণ সক্ষমতায় ব্যবহার না হলেও এ অর্থ দিতেই হয়।

দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি কেনায় কাতার এনার্জি ট্রেডিংয়ের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৬ সাল থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু করবে। ওমানের ওকিউ ট্রেডিংও ২০২৬ সাল থেকে এলএনজি সরবরাহ করবে। তবে তাদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ ১০ বছর। একই বছর এক্সিলারেট এনার্জিও ১৫ বছরের জন্য এলএনজি সরবরাহ শুরু করবে।

অন্যদিকে প্রথমবারের মতো এলএনজি আমদানির জন্য বিদেশি ঋণ নেয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) এজন্য ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)। যদিও এই ঋণ কী শর্তে নেয়া হয়েছে, তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে শোনা যাচ্ছে সুদের হার হবে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (সোফর) সঙ্গে দুই শতাংশ। মানে হলো, বর্তমান সোফরের যে হার তাতে সুদ গুনতে হবে সাড়ে সাত শতাংশের মতো। এই ঋণ খুব অল্প সময়ে পরিশোধ করতে হবে। এর বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও রাখতে হবে। সূত্র: শেয়ারবিজ